বাগদা চিংড়ি মাছ চাষ করার নিয়ম- বাগদা চিংড়ি মাছ কিভাবে চাষ করতে হয়?

আমাদের দেশ কৃষি প্রধান দেশ। এই কৃষি প্রধান দেশে মানুষ বিভিন্নভাবে কৃষি কাজ করে তাদের জীবন জীবিকা নির্বাহ করে। তার মধ্যে একটি হল মাছ চাষ করে। আমরা অনেকেই বাগদা চিংড়ি মাছ চাষ করতে চাই। কিন্তু কেউ জানি না কিভাবে বাগদা চিংড়ি মাছ চাষ করতে হবে।
বাগদা চিংড়ি মাছ চাষ করার নিয়ম

আমাদের দেশের মানুষদের মাছ চাষের বুদ্ধি, মাছ চাষের পদ্ধতি এবং নিয়ম সম্পর্কে না জানা থাকার কারণে তারা বিভিন্নভাবে ক্ষতির সম্মুখীন হয়ে থাকে। ঘেরের অবকাঠামোগত প্রস্তুতি থেকে শুরু করে পোনা মজুদ, পানি ও মাটি ব্যবস্থাপনা, সার, চুন ও খাদ্য প্রয়োগ ব্যবস্থাপনা ইত্যাদি ক্ষেত্রে প্রয়োগের জ্ঞানের অভাব মূলত: উৎপাদন বৃদ্ধির প্রধান অন্তরায়।

খাল,পুকুর, বা ঘের নির্বাচন ও প্রস্তুতি

  • এমন জায়গা যেমন-খাল বা ঘের নির্বাচন করতে হবে যে জায়গার পানি জোয়ারের পানি দ্বারা সহজেই পরিবর্তন করা যায়। পানি উঠানামা করার জন্য যেন অন্য কিছুর উপর নির্ভরশীল হতে না হয়।
  • জায়গার আয়তন ০.৫-১.০ হেক্টর হলে ব্যবস্থাপনা এবং মাছ চাষ ভালো ও সহজ হবে।
  • ফেব্রুয়ারি মাসের মাঝামাঝি সময়ে অর্থাৎ মার্চ মাসের শুরুর দিকে সেই ঘেরের পানি শুকিয়ে তলদেশে পর্যাপ্ত সূর্যালোক লাগাতে হবে।
  • মাছ চাষের স্থানের তলদেশে সমান করতে হবে। ঘেরের পানির গড় গভীরতা ১.০-১.২ মিটার ধরে রাখার জন্য পাহাড় যত সম্ভব উঁচু মজবুত করতে হবে।
  • ঘেরের পার ও তলদেশ ভালোভাবে মেরামত করতে হবে যাতে পানি চুইয়ে না যায় বা অন্য অন্য ঘেরের পানি প্রবেশ করতে না পারে।
  • তারপর পানি উত্তোলন গেটে বাঁশের পাতা ও নাইলনের মশারির নেট দিয়ে স্ক্রিন তৈরি করতে হবে। রাতে পানি উত্তোলনের সময় সহজেই যেন অবাঞ্ছিত মাছ বা প্রাণী প্রবেশ করতে না পারে।

ঘের প্রস্তুতি ও নার্সারির ব্যবস্থাপনা

মাটির পিএইচ এর উপর ভিত্তি করে নার্সারি ও ঘেরের পরিমিত হারে চুন প্রয়োগ করতে হবে। ঘেরো না স্যারের প্রস্তুতকালীন সময়ে তলদেশে ও পাহাড়ের উপর অংশ পর্যন্ত হেক্টর প্রতি ৩০০-৩৫০ কেজি হারে ডলোমাইট ও ক্যালসিয়াম অক্সাইড এর মিশ্রণ প্রয়োগ করা যেতে পারে অথবা ক্যালসিয়াম অক্সাইডের মিশ্রণ ১:২ অনুপাতে প্রয়োগ করা যেতে পারে।

কিংবা শুধুমাত্র ডলোমাইট ও পাথরের চুন উল্লেখিত হারে ছিটিয়ে প্রয়োগ করা যেতে পারে।চুন প্রয়োগের তিন থেকে সাত দিন পর নার্সারিতে ৬০-৭০ সেন্টিমিটার জোয়ারের পানি ঢোকাতে হবে যাতে অবাঞ্ছিত ও রাক্ষসে মাছ ঘেরে প্রবেশ করতে না পারে।পানি উত্তোলনের পর 25 পি পি এম হারে ব্লিচিং পাউডার প্রয়োগ করা যেতে পারে। 

এতে অবাঞ্চিত ও অন্যান্য রাক্ষসের মাছ ও প্রাণী মারা যেতে পারে।তারপর নার্সারির পানিতে ২ থেকে ২.৫ পিপিএম হারে ইউরিয়া,৩ থেকে ৩.৫ পিপিএম হারের টিএসপি,০৭-০৮ পিপিএম হারে পটাশ এবং সার হেক্টর প্রতি ৩০ কেজি হারে চিটাগুড় প্রয়োগ করা যেতে পারে। এইভাবে প্রাকৃতিক উপায়ে ব্যবহার করলে আশা করা যায় ভালো ফল পাওয়া যাবে।

চিংড়ির পোনা মজুদকরন

ব্যবস্থাপনার উপর ভিত্তি করে প্রতি বর্গ মিটার ১০-১২ টি সুস্থসবল ও ভাইরাস মুক্ত বাগদা চিংড়িপনা মজুদ করা কারণ এটি হলো অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে বেশি লাভজনক এবং পরিবেশবান্ধবপ্রয়োজনীয় সংখ্যক মাছের পোনা নার্সারিতে মজুদ করতে হবে।১৫ থেকে ২০ দিন প্রতিপালনের পর নার্সারীর ঘেরা জাল তুলে দিলে চিংড়ি সম্পন্ন ঘেরা ছাড়িয়ে যাবে।

চিংড়ি মাছের জন্য খাদ্য সরবরাহ

  • নার্সারিতে পোনা মজুদের পরে দৈনিক ৬ ঘন্টা অন্তর প্রথম ও দ্বিতীয় এবং তৃতীয় সপ্তাহের মোট পোনার ওজনের যথাক্রমে ১০০ থেকে ১২৫%, ৮০% এবং ৬০% হারে নার্সারিতে খাদ্য প্রয়োগ করতে হবে।
  • সম্পূর্ণ ঘিরে পোনা অবমুক্ত করার পর অর্থাৎ চাষের চতুর্থ পঞ্চম এবং ষষ্ঠ সপ্তাহে পর্যাপ্ত পরিমাণে দৈনিক ৬ ঘন্টা অন্তর মোট বোন আর ওজনের যথাক্রমে ৩০%, ২০%, এবং ১০% খাদ্য ছিটিয়ে প্রয়োগ করতে হবে।
  • এরপর চাষের ৭০ থেকে ৭৫ দিন পর্যন্ত দৈনিক ৬ ঘন্টা অন্তর এবং পরবর্তী দিন সমূহে দৈনিক চার ঘন্টা অন্তর খাদ্যর প্রয়োগ করতে হবে। এজন্য প্রতি হেক্টর সমান দূরত্বের ১৪০থেকে ১৫০ টি খাবারের রে ট্রে স্থাপন করতে হবে। খেয়াল রাখতে হবে যাতে ট্রেতে অতিরিক্ত খাবার অবশিষ্ট না থাকে।
  • খাদ্য প্রয়োগের পর আনুমানিক এক ঘন্টা প্যান্ডেল হুইল কিংবা পাম্প চালানো যাবে না।
  • চিংড়ি স্বাভাবিক বৃদ্ধির জন্য ৩০ থেকে ৪০% আমিষ এবং ২০ থেকে ৩০% শর্করা ও মিনারেল সমৃদ্ধ খাবার পিলেট খাবার প্রয়োজন।

বাতাস ও অক্সিজেন সরবরাহ

  • ঘিরে দ্রবীভূত অক্সিজেনের মাত্রা ৪ বিপিএমএ নেমে এলে পেডেল হুইল কিংবা পাম্প চালিয়ে অক্সিজেন সরবরাহের ব্যবস্থা করতে হবে।
  • পানের স্বচ্ছতা ৩৫ সেন্টিমিটার এর বেশি হলে পানিতে ইউরিয়া এবং টিএসপি প্রয়োগ করতে হবে।
  • চুন ও সার প্রয়োগ
  • পিএইচ এর মাত্রা ৭ .৫ এর নিচে নেমে গেলে কিংবা সকাল ও বিকেলে পিএইচ এর মাত্রা ০.৫ এর বেশি হলে অবশ্যই চুন প্রয়োগ করতে হবে। এই অবস্থায় প্রতি হেক্টর ১০ থেকে ১৫ পিপিএম হারে হলো গাড়ো চুন প্রয়োগ করা যেতে পারে।
  • পানের স্বচ্ছতা ৩৫ সেন্টিমিটার এর বেশি হলেই ১.০ থেকে ১.২ পিপিএম ইউরিয়া এবং ১.৫ থেকে ১.৮ পি এস পি প্রয়োগ করা যেতে পারে।

পানি সরবরাহ ও নিষ্কাশন

পানি সরবরাহের প্রয়োজন হলে জবাব 8 থেকে 10 দিন পর ঘিরে সরবরাহ করতে হবে ঘেরে কোন পানি পরিবর্তন করা যাবে না।

চুন ও সার প্রয়োগ

পি এইচ ৭.৫ এর নিচে নেমে গেলে কিংবা সকাল ও বিকেলে পিএইচ এর মাত্রা ০.৫ এর বেশি হলে অবশ্যই চুন প্রয়োগ করতে হবে। এ অবস্থায় প্রতিদিন ১০ থেকে ১৫ পি পি এম হারে করতে হবে। চুন প্রয়োগ করার ফলে আমরা মাছের বেঁচে থাকা সুনিশ্চিত করতে পারব। অনি স্বচ্ছতা ৩৫ সেন্টিমিটারের বেশি হলে ১.১-১.৫ অনুপাতে চুন প্রয়োগ করতে হবে। তারপর পর্যায়ক্রমে সার প্রয়োগ করতে হবে।

আগাছা নিয়ন্ত্রণ

যে কোন ধরনের জল আগাছা সিঙ্গেল চাষের জন্য একটি মারাত্মক বাতাস সম্মুখীন হয়ে থাকে। কারণ জল আগাছা জন্মালে পানের গুণমান নষ্ট হয়ে যায় এবং পানিতে বিভিন্ন ধরনের কীটপতঙ্গ জমাতে পারে যার ফলে চিংড়ির গায়ে কালো কালো দাগ দেখা যায় এবং চিংড়িতে প্রচুর পরিমাণে অসুখ-বিসুখ দেখা যায়। তাই দৈনিক আমাদের আকাশে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে এবং বিভিন্ন শ্রমিক দ্বারা আগাছা গুলোকে পরিষ্কার করাতে হবে।

ব্যাকটেরিয়া নিয়ন্ত্রণ

ব্যাকটেরিয়া নিয়ন্ত্রণে পুকুরে জমাকৃত জৈব পদার্থ, পানিতে দ্রবীভূত অক্সিজেন, পি এইচ ও তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে বিশেষ ভূমিকা পালন করে। পর্যাপ্ত অক্সিজেন ও জৈব পদার্থের পরিমাণ নিয়ন্ত্রণে থাকলে ক্ষতিকারক ব্যাকটেরিয়া বংশবৃদ্ধি করতে পারেনা।

তাই ক্ষতিকারক ব্যাকটেরিয়াকে বংশবৃদ্ধি না করানোর জন্য আমাদের বিভিন্ন ধরনের ব্যাকটেরিয়া নাটক ব্যবহার করতে হবে। ব্যাকটেরিয়া কমানোর জন্য রাসায়নিক পদ্ধতিতে প্রাকৃতিক ভাবে জৈব প্রযুক্তি ব্যবহার করে ব্যাকটেরিয়াকে ধ্বংস করতে হবে। ব্যাকটেরিয়াকে ধ্বংসের জন্য দুটি পদ্ধতি রয়েছে। যথা-

রাসায়নিক পদ্ধতি

পুকুরে ব্যাকটেরিয়ার পরিমাণ নিয়ন্ত্রণের জন্য চাষের ৪০ থেকে ৪৫ দিন পর থেকে প্রতি মাসে একবার ব্লিচিং ব্যবহার করতে হবে। এতে জন্মানো বিভিন্ন ধরনের সাধারণ ব্যাকটেরিয়া গুলো মারা যায়। যার ফলে চিংড়ি খুব ভালোভাবে বাড়তে পারে।

জৈব প্রযুক্তি

ব্যাকটেরিয়া আন্দোলনের জন্য প্রোবায়োটিক্স ব্যবহার করা যেতে পারে। সাধারণত চাষের 40 থেকে 45 দিন পর থেকে ব্লিচিং পাউডার প্রয়োগের দুইদিন পর এক বোতল হারে প্রোবায়োটিকস প্রয়োগ করা যেতে পারে। মাটির সাথে মিশিয়ে মন করে সরবরাহ করলে বা ব্যবহার করলে ভালো ফলাফল পাওয়া যাবে।

পানিতে দ্রবীভূত ক্ষতিকারক গ্যাস নিয়ন্ত্রণ

ঘিরে প্রয়োজনে অক্সিজেন ছাড়াও সিঙ্গের জন্য ক্ষতিকারক বিভিন্ন ধরনের গ্যাস থাকে। এই গ্যাস গুলোকে নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে আমাদের চাষ ভালো হবে না। এসব ক্ষতিকারক গ্যাস নিয়ন্ত্রণের জন্য নিম্নলিখিত পদক্ষেপগুলো গ্রহণ করতে হবে।-
  • চাষের দু মাস পর থেকে অন্তত 30 থেকে 40 % পানি পরিবর্তন করলে পুকুরে প্রতিকূল অবস্থা সৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনা কম থাকে।
  • পুকুরের কোন প্রকার জৈব সার প্রয়োগ হতে সম্পূর্ণরূপে বিরত থাকতে হবে।
  • পর্যাপ্ত পরিমাণে অক্সিজেনের উপস্থিতি নিশ্চিত করতে হবে
  • এমনই আর পরিমাণ নিয়ন্ত্রণের জন্য চাষের ৫০ দিন পর থেকে প্রতি মাসে দুই বোতল পরিমান হারে জিও লাইট ব্যবহার করা যেতে পারে।
  • পানি কিংবা মাটিতে ক্ষতিকারক ব্যাকটেরিয়ার বংশ বৃদ্ধি রোধ করতে হবে।
  • পুকুরে প্ল্যানটন উৎপাদনের সহনশীল মাত্রা বজায় রাখতে হবে।
  • চাষের ৫৫ থেকে ৬০ দিন পর মাঝে মাঝে মাটিতে ধীরগতিতে হোররা টেনে দিলে মাটির অপ্রয়োজনীয় ক্ষতিকারক গ্যাস বের হয়ে যায়।

চিংড়ির বৃদ্ধি ও স্বাস্থ্য পরীক্ষা

  • চাষকালীন সময়ে সপ্তাহে একবার চিংড়ির বৃদ্ধি পরীক্ষায় এবং দৈনন্দিন অন্তত একবার স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা বিশেষ প্রয়োজন।
  • খাবার প্রয়োগের এক ঘন্টা পর ট্রেনে তুলে ট্রেতে আসা শ্রেণী সমূহ ধরে নির্বাচন স্বাভাবিক আছে কিনা এবং শ্রেণীর খাদ্যনালীতে পর্যাপ্ত খাদ্য আছে কিনা পরীক্ষা করা যেতে পারে।
  • চিংড়ির গায়ে কোন রোগ আছে কিনা তা পরীক্ষা করতে হবে এবং পর্যবেক্ষণ করে ওষুধ দিতে হবে।
  • কোন চিংড়ি পাড়ের কাছাকাছি স্থির ভাবে বসে থাকলে বুঝতে হবে যে ধীরে কোন অস্বাভাবিক অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। এমন তো অবস্থায় স্বাভাবিক করার জন্য উচিত জরুরি পদক্ষেপ গ্রহণ করা।
  • চিংড়ির বসে থাকা দেখলে ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করতে হবে।
  • রোগ প্রতিরোধের স্বার্থে পরিশোধিত ব্যতীত কোনক্রমে একঘেরে ব্যবহৃত জিনিসপত্র অন্য ঘারে ব্যবহার করা যাবে না।

পরামর্শ

  • চিংড়ি আহরণের পর ঘেরের জৈব পদার্থ সমৃদ্ধ পানি ও তলায় অবস্থিত বর্জ্য পদার্থ বাইরে বের না করে পুকুরের রিসাইকেলিং করার জন্য ফসল চক্র ভিত্তিক চাষ ব্যবস্থা গ্রহণ করা যেতে পারে।
  • এজন্য দ্বিতীয় ফসলে আবর্জনা চাষ করলে ভালো ফল পাওয়া যাবে
  • অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে ফসল ভিত্তিক চাষ ততটা লাভজনক না হলেও পরিবেশ প্রযুক্তি হিসেবে আবদ্ধ পদ্ধতির চাষে ফসল চক্রের ব্যবহার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

লেখক এর মন্তব্য

প্রিয় পাঠক আপনারা হয়তো এতক্ষণে উপলব্ধ আলোচনার মাধ্যমে ভালোভাবে বুঝে গিয়েছেন কিভাবে বাগদা চিংড়ি চাষ করতে হবে। যদি আজকের এই আর্টিকেলটি ভালো লাগে তাহলে অবশ্যই বন্ধু বান্ধবের মধ্যে শেয়ার করে তাদেরও জানার সুযোগ করে দিন

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

অর্ডিনারি আইটির নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url

এইটা একটি বিজ্ঞাপন এরিয়া। সিরিয়ালঃ ১